আমরা যখন কোনো মেয়ের ধর্ষিতা হবার সংবাদ পত্রিকার পাতায় পড়ি কিংবা ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারি, তখন দেখি দুই ধরণের মানুষ নিজস্ব মতামত নিয়ে হাজির হয়েছে।
প্রথম পক্ষ বলছে- মেয়েটার পোশাক এবং চলাফেরায় সমস্যা ছিলো, তাই রেপড হইছে। শালীন পোশাক পরিহিতারা কখনই রেপড হয় না।
দ্বিতীয় পক্ষ বলছে- সমস্যা পোশাকে নয়, মানসিকতায়। একটা মেয়ে যা খুশী তাই পরতে পারে, তাই বলে আপনি তাকে রেপ করতে যাবেন? আগে নিজের মানসিকতা ঠিক করেন।
প্রথমে আমি আমার নিজের অবস্থানটা পরিষ্কার করে নেই। রেপ কখনই পোশাকের কারণে হয় না। রেপের মূল কারণ বিকৃত মানসিকতা। এখন এই বিকৃত মানসিকতা এলো কোথা থেকে? এটা কি একদিনে তৈরী হয়েছে? কারো ফ্যামিলি যত খারাপই হোক না কেন, তারা নিশ্চয়ই সন্তানকে ধর্ষণের শিক্ষা দেন না। আগে তো ধর্ষণের পরিমাণ এত বেশী ছিলো না। এখনকার তুলনায় আগে মেয়েদের অনেক বেশী সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হতো। ইদানীং মেয়েদের একজন মানুষ হিসেবে যতটা নয়, তারচাইতে ভোগ্যপণ্য হিসেবে বেশী দেখা হয়। আগেও এমন মানসিকতা ছিলো না, তা বলছি না। তবে মাত্রাটা ছিলো অনেক কম।
মেয়েরা এখন আগের চাইতে শিক্ষা দীক্ষায় অনেক এগিয়ে। কর্মক্ষেত্রে তারা পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। তারপরও মেয়েদের প্রাপ্য সম্মানটা সঠিকভাবে দেয়া হয় না। কেন?
এর পেছনে মিডিয়া, পশ্চিমা সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকাংশে দায়ী। তারা সব কিছুতে মেয়েদের শরীরকে পুঁজি করে নিজেদের পণ্য বিক্রির চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। তাদের থিওরি হলো, যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত পোশাকে মেয়েটাকে গ্ল্যামারাসভাবে সবার সামনে হাজির করতে হবে। একজন নারীকে দিয়ে যৌনাবেদন সৃষ্টির মাধ্যমে তারা তাদের পণ্য বিক্রির প্রচেষ্টা চালায়। তারা কিন্তু একজন উদোম পুরুষকে দিয়ে যৌনাবেদন সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালায় না। তাদের থিওরিতে নারী যত স্বল্প বসনা, তার সেক্স এ্যাপিল তত বেশী। সেই নারীকে প্রচারের কাজে ব্যবহারে তাদের বিক্রিও তত বাড়তি। পুরুষেরা তাই এসব দেখে দিন দিন মেয়েদের পণ্য হিসেবেই গণ্য করছে।
নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা অন্ধভাবে পশ্চিমা সংস্কৃতি অনুসরণে ব্যস্ত। তারা পশ্চিমাদের পোশাকআশাক ফলো করছে, হেয়ার স্টাইল ফলো করছে, ‘ফা* ইউ, মাদা*ফা*র’ জাতীয় গালিগালাজ ফলো করছে, কিন্তু তাদের ভালো দিকগুলো ফলো করছে না। ওরা চ্যারিটির মাধ্যমে মানুষকে সাহায্য করে, নিজের দেশের রাস্তাঘাট ক্লিন রাখে, লোক ঠকিয়ে ব্যবসা করে না। ওদের আইনকানুন কড়া, কথায় কথায় ঘুষ দেয় না/খায় না। উল্টো রাস্তায় গাড়ি চালায় না। এই ভালো জিনিসগুলো ফলো করছে না। বেশী দূরে না যাই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের একজন নাগরিক তার নিজের দেশকে যতটা ভালোবাসে, একজন বাঙ্গালী কি নিজের দেশকে তার সিকি ভাগও বাসে?
পঁচিশ ত্রিশ বছর আগে মুক্তি পাওয়া এবং হাল জামানার দুটো মুভি নিয়ে দেখতে বসুন, মানসিকতা বদলে যাওয়ার পার্থক্যটা কিছুটা হলেও ধরতে পারবেন। পুরোনো মুভিটাতে গল্প এবং অভিনয়ের প্রতি জোর দেয়া হয়েছিলো আর নতুন মুভিতে নাচ, গান, রেপ সিন, আইটেম সং, নায়িকার শরীরের বাঁক প্রদর্শন সর্বোপরি গ্ল্যামার বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়া হয়।
আচ্ছা একজন টম ক্রুজ কিংবা একজন শাহরুখ খানের মুভিতে নায়িকা কে বা কী করছে, এসব নিয়ে আপনি কি খুব বেশী মাথা ঘামান? এদের ছবিতে যৌনাবেদন খুঁজতে যান? মনে হয় না। এরা একাই পুরো মুভিতে আপনার মনোযোগ ধরে রাখে। আফসোস, আমাদের দেশে এমন কেউ নেই। তাই পরিচালক আর প্রযোজকরা ভাবেন, নায়িকার দেহের বাঁক প্রদর্শন করে দর্শকদের আকৃষ্ট করতে হবে। এখন টিভি নাটকের পোশাকেও পরিবর্তন চলে এসেছে। কেউ কেউ বলবেন, আরে এসব তো বর্তমান ফ্যাশন ট্রেন্ড। কিছু কিছু টিভি নায়িকা নাটকে তাদের ক্লিভেজ প্রদর্শন করে। এসব ফ্যাশন? সরাসরি দেখানো না হলেও এমন কিছু ইঙ্গিতপূর্ণ দৃশ্য দেখানো হয়, যা ড্রয়িংরুমে সপরিবারে বসে দেখাটা প্রচণ্ড অস্বস্তিকর। এগুলোও ট্রেন্ড?
একটা সময় ফেসবুক ছিলো না। ইন্টারনেট ছিলো না। মোবাইল ছিলো না। একটা মেয়ের মন গলাতে তখন একটা ছেলেকে রীতিমত পর্বতশৃঙ্গ পাড়ি দিতে হতো। মনের ভাব প্রকাশে চিঠি লেখা ছাড়া অন্য আর কোনো উপায় ছিলো না। চিঠি লিখতে নিজের সৃজনশীলতাকে কাজে লাগাতে হতো। কাঠফাটা রোদে মেয়েটি এই পথ দিয়ে যাবে, এই আশায় ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। একজনের মন জয় করতেই এত কষ্ট করতে হতো যে, তাকে সহজে ছেড়ে যাবার কথা কল্পনাতেও আসতো না।
এখন আর সে দিন নেই। ঘরের বাইরেও যেতে হয় না। ঘরে বসেই ফেসবুকে কিছু মিষ্টি কথায় একটা মেয়ের সাথে রিলেশনশিপ বিল্ডআপ করা যায়। ছেলেটা যদি ভালো ভালো কিছু কথা লিখতে পারে, তাহলে ব্যাপারটা আরও সহজ হয়ে দাঁড়ায়। তারপর পার্কে রেস্টুরেন্টে ডেট, সুযোগ বুঝে রুমডেট এবং একটা পর্যায়ে গিয়ে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে ফিজিক্যাল রিলেশন। এরপর স্বভাবতই মেয়েটিকে তার আর আগেরমত ভালো লাগে না। ফলাফলঃ ব্রেকআপ এবং নতুন
আরেকজন সঙ্গীর খোঁজে এখানে ওখানে ঢুঁ মারতে শুরু করা।
মিডিয়া বলুন আর রিলেশনের কথাই বলুন, প্রতিটা ক্ষেত্রে কিন্তু ছেলেরাই খুব সূক্ষ্মভাবে মেয়েদের ইউটিলাইজ করে যাচ্ছে। যেটা মেয়েরা প্রায়শই ধরতে পারে না। মেয়েদের ড্রেস ডিজাইনার কারা? বেশীরভাগই পুরুষ। অতি সূক্ষ্মভাবে মেয়েদের মাথায় কিছু পুরুষ এই কথাগুলো ঢুকিয়ে দিচ্ছে এভাবে- ‘তোমার শরীর, তুমি যা খুশী তাই পরবা। ওরা দেখবে কেন? ইসলামে ছেলেদের দৃষ্টি সংযত রাখতে বলা হয়েছে। ওদের উচিৎ নিজেদের মানসিকতা বদলে ফেলা।’ আপনার শরীর আপনি দেখাবেন, যেমন ইচ্ছা পোশাক পরবেন, এটা অবশ্যই আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে এটাও ঠিক, এ ধরণের পোশাক পরলে আশেপাশের লোলুপ দৃষ্টিগুলো ঠিকই আপনার শরীরটা চোখ দিয়ে চেটেপুটে খাবে। তাদের এই সুযোগটা আপনিই করে দিচ্ছেন। এদের যতই দৃষ্টি সংযত করার কথা শোনান না কেন, তাদের মাথায় ঢুকবে না। এদের চরিত্র পঁচে গিয়েছে।
একটা মানুষ রাস্তাঘাটে এসব দেখে, বাসায় বসে পর্ন দেখে, এর ইফেক্টটা পড়ে তার চরিত্রে। ইন্টারনেটে এবং মোবাইলে সহজলভ্য পর্নের কারণে স্কুলের ছোট ছোট ছেলেরাও লুকিয়ে মেয়েদের নগ্ন শরীর দেখছে। তারা তাদের কচি মনে এই ধারণা নিয়ে বড় হচ্ছে, মেয়েদের সাথে বুঝি এমনই করতে হয়। মেয়েমানুষ মানেই সেক্স। এরাই পরবর্তীতে সুযোগ পেয়ে ক্লাসমেট, প্রতিবেশী মেয়ে, এমনকি নিজের আত্নীয়াদেরকেও ছাড় দেয় না। শিশুদের ধর্ষণ করে এটা ভেবে, বাচ্চা মানুষ কাউকে কিছু বলতে পারবে না। ধর্ষণের পর ধরা পড়ে যাবার প্রচণ্ড ভয় থেকে এরা খুন পর্যন্ত করে বসে। পৃথিবীর যাবতীয় ক্রিমিনালেরা মানসিকভাবে দুর্বল চিত্তের অধিকারী হয়ে থাকে। দুর্বল চিত্তের মানুষ বলেই নার্ভাস ব্রেক ডাউনের শিকার হয়ে খুন করে বসে।
এই বিষয়গুলো বন্ধ না করে কীভাবে আপনি মানসিকতায় পরিবর্তন আনবেন? সরকার পর্ন সাইটগুলো বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে সাধুবাদ জানাই। তারপরও অনেকেই বিকল্প পন্থায় দেখছে। ভবিষ্যতেও দেখবে। তবে সহজলভ্যতা অনেকাংশে কমে আসবে।
একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করি, লক্ষাধিক মেম্বার সমৃদ্ধ গ্রুপ DSU-তে এরকম একটা পোস্ট দেখেছিলাম, ফ্রেন্ডের সাথে সেক্স করতে চাও কিংবা করেছো কে কে? ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও খুব বোল্ডলি কমেন্টে জানিয়েছিলো, তাদের অনেকেই করেছে এবং তা রিলেশনশিপে থাকা অবস্থায়। হতবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, কেউ কেউ তাদের কাজিনদের কথাও কমেন্টে জানাচ্ছে। কাজটাকে তারা কেউই খারাপ বলে মনে করছে না। এটা করায় তাদের মনে কোনো অপরাধবোধ নেই। ভাবতে পারেন মানুষ কতটা নষ্ট হয়ে গেলে, কতটা নিচে নেমে গেলে অন্যায় কিছু করেও সেটাকে অন্যায় ভাবে না, কোনো অপরাধবোধে ভোগে না।